ফেরাউন
মিশরের কিবতীদের মধ্যে ওলিদ নামে একজন ধনী কৃষক কোন এক গ্রামে বাস করত। এই ওলিদের ঘরে জন্মগ্রহন করে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত কুখ্যাত শয়তান কাবুস ওরফে ফেরাউন। কিবতী ভাষায় কাবুস শব্দের অর্থ হচ্ছে নির্ভীক। ছেলেটির চেহারা দেখতে মন্দ না। সে ওলিদ পরিবারে খুব আদরের সন্তান ছিল। পিতা-মাতার অত্যাধিক আদর-যতে লালিত-পালিত হয়ে কাবুস একান্ত বাল্যকাল হতেই নিতান্ত দুর্বৃত্ত ও পাষন্ড হয়ে উঠেছিল। পরিনত বয়সে ছেলেটি দুস্কৃতিকারী ও চরিত্রহীনরূপে আত্নপ্রকাশ করে। পাশের গ্রামে হাম্মান নামে তার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। উভয়ে অনেক সময় একত্রে মিলে বহু অকর্ম করত।
উভয়ের পিতা-মাতা তাদেরকে চরিত্রবান করার জন্য আদরের সাথে সাথে তিরস্কারও কম করেনি। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
মিশরীয় কিবতীগণ নিজেদেরকে সর্বদা খানদানী বলে দাবী করত। সৌর্য্য, বীর্যে, শক্তি, সাহসে ও কলা-কৌশলে তারা সেরা ছিল। শঠতা ও ধোকাবাজি ছিল তাদের আর একটি গুণ।
এই কাবুস যখন পরিণত বয়সে উপনিত হয়, তখন তার পিতা ওলিদ তাকে সংসার মুখী করার জন্য বিবাহের কথা চিন্তা করতে থাকে। শুরু হল কন্যা দেখা । পছন্দ মত পাত্রী কিবতীদের মধ্যে পাওয়া গেল না। পরে তারা জানতে পারল , বনী ইসরাইলদের মধ্যে মাজহামের কন্যা আছিয়া যেমন সুন্দরী, তেমন ধর্ম পরায়ণ ও বিদুষী। মেয়েটিকে ওলিদের পছন্দ হয়ে গেলো। হোক না সে বনী ইসরাইলী কন্যা। কন্যা পক্ষের নিকট যথা সময়ে প্রস্তাব চলে এলো।
মাজহাম সাত পাঁচ চিন্তা করে এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। তিনি চিন্তা করলেন আমরা মিশরে নির্যাতিত ও অবহেলিত। ওদের সাথে রক্তের সম্পর্ক করলে সময় অসময় ওদের বিভিন্ন্ মূখী সাহায্য পাওয়া যাবে। তাছাড়া বনী ইসরাইলদের সঙ্গে কিবতী ছেলে-মেয়েদের বিবাহ-শাদী পূর্ব হতেই চালু ছিল। কাবুস দেখতে শুনতে মন্দ ছিল না। তবে কিনা চরিত্রহীন। সে যাই হোক ,আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় অবশেষে কাবুসের সঙ্গে হযরত আছিয়ার বিবাহ হয়ে গেলো।
হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মের প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে কাবুস নিজের বুদ্ধি ও ভাগ্যের গুনে দ্বিতীয় রামসিস উপাধি ধারন করে মিশরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। ফেরউন প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়। মিশরের বাদশাহদেরকে ফাঁরাও বা ফেরাউন বলা হত। দুনিয়া জুড়ে ছিল তাদের খ্যাতি। সুতরাং মিশরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে কাবুস ওরফে দ্বিতীয় রামসিস ফেরাউন নামে অভিহিত হয়েছিল।
মহাগ্রন্থ আল-কোরান মাজীদে সেই পাপত্নাকে ফেরাউন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেজন্য আমরাও তাকে ফেরাউন বলেই উল্লেখ করব। অবশ্য এরও একটি বিশেষ কারন আছে। মিশরের বাদশাহদের মধ্যে এমন দুর্বৃত্ত আর পাষন্ড পাপত্না বাদশাহ দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না।
ফেরাউন নিতান্ত হীন অবস্থা থেকেই নিজের প্রখর বুদ্ধি ও ভাগ্যের গুনে মিশরের সিংহাসনে আরোহন করেছিল। তার মত মহাপাপী আর অত্যাচারী বাদশাহ মিশরের ইতিহাসে দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পবিত্র হাদিসে ফেরউনের অনেক পাপ কর্মের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ”আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করাইলাম এবং ফেরাউন ও তাহার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য সহকারে সীমালংঘন করিয়া তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিল। পরিশেষে যখন সে নিমজ্জমান হইল তখন বলিল, আমি বিশ্বাস করিলাম বনী ইসরাইল যাহাতে বিশ্বাস করে। নিশ্চয় তিনি ব্যতিত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসর্পণকারীদের অর্ন্তভুক্ত।
এখন! ইতিপূর্বে তো তুমি অমান্য করিয়াছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলে। আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করিব যাহাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হইয়া থাকো । অনশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্বন্ধে গাফেল। ( ১০:৯০-৯২ )
এখানে ফেরাউন সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন । শিশুকাল থেকেই ফেরউন ছিল দুর্দান্ত, পাষন্ড আর অত্যাচারী। তার অত্যাচারে নিরীহ গ্রামবাসিগন পর্যন্ত অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার পিতা-মাতা তাকে সংশোধন করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু সবই বিফল হয়েছিল।
অবাধ্য কাবুসকে কিছুতেই নিজেদের আয়েত্তে আনতে পারল না।
যৌবনের প্রারম্ভে কাবুস কত যে কুকাজ করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কত সতী-সাধ্বী নারীর সতীদ্ব হরণ করেছে তার কোন লেখাজোখা নেই। মোটকথা এমন কোন কুর্কম ছিলো না যা সে করতে পারত না।
ফেরউনের খোদায়ী দাবী
ফেরাউন এবং হামানের মধ্যে সুখের আলাপচারিতা চলছে। হামান বলল বন্ধু তুমি আজ বড়ই ভাগ্যবান। আজ তুমি মিশরের বাদশাহ! কত মানুষ তোমাকে সম্মান করেন।
ফেরাউন হেসে বলল , তোমার সৌভাগ্যটাও এখন কোন অংশে কম নয়।
তুমি ছিলে পকেটমার ,চোর , পাক্কা জুয়াড়ী। ভাগ্য গুনেই হয়েছো আজ মিশরের সাম্রাজ্যের মহামান্য ফেরাউনের প্রধানমন্ত্রী- একবারে ভুইফুড়ে তালগাছ হয়েছো।
শুনে হামান বলল- আমরা দু’জনই ভাগ্যবান। আমরা দু’জন মিলে কঠোর পরিশ্রম করেছি। তাই আজ সে শ্রমের মর্যাদাও পেয়েছি। উন্নতির চরম শিখরে পৌছেছি।
ফেরাউন বলল আমি আরো বড় হতে চাই, শুধু এ পযর্ন্ত আমার শেষ নয়।
হামান বিস্মিত কন্ঠে বলল , এরপর আর কি হতে চাও বন্ধু? দেশের বাদশাহ হওয়ার পর উচ্চপদ আর কি আছে? কি চাই তোমার?
ফেরাউন সগর্বে উত্তর দিল, আমি এখন নিজেকে খোদা বলে ঘোষণা করতে চাই।
শুনে হামান যেন আকাশ থেকে পড়ল- এসব কি বলছো বন্ধু! তা কি করে সম্ভব হয়?
ফেরাউন সগর্বে বলল - সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাই।
হামান বলল, এই ত্রিভুবনের খোদা তো একজন আছেন। যিনি তোমাকে, আমাকে এমন কি এই ত্রিভুবনের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হায়াত, মউত , ধন-দৌলত সবকিছু যার হাতে , তিনিই খোদা। তুমি আবার খোদা হবে কি করে?
ফেরউন বলল, আমি তাই হতে চাই বন্ধু! সারা পৃথিবীর খোদা আপাততঃ না হতে পারলেও এই মিশর সাম্রাজ্যের খোদা আমি হবই।
হামান বলল- তা হয় না বন্ধু । তুমি নিজেকে খোদা বলে ঘোষণা করলেও দেশের জনগন কখনো তোমাকে খোদা বলে স্বীকার করবে না। কারন দেশের প্রায় লোক নবী ইউসুব (আঃ) এর সত্য ধর্ম পালন করে। তুমি নিজেকে খোদা বলে ঘোষণা করলেও তারা কখনো তোমাকে খোদা বলে স্বীকার মানবে না বরং আরও বিদ্রোহী উঠবে। চারিদিক থেকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে।
ফেরাউন একথা শুনে ক্রোধে জ্বলে উঠল এবং বলল, এ রাজ্যের কার এমন শক্তি আছে, যে আমার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবে? আমি তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিব।
হামান হেসে বলল ধীরে বন্ধু ধীরে! অত জোরে লাফ দিলে ঠ্যাং ভেঙ্গে যাবে। সারা দেশের লোক যদি তোমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায় , তাহলে তুমি কয়জনকে দমন করবে? আর কয়জনকেই বা শাস্তি দেবে? জেনে রেখো একটা রাজশক্তির চেয়ে জনমতের শক্তি বেশি প্রবল।
শুনে ফেরাউন হতাশ কন্ঠে বলল- তাহলে কি আমার এই উচ্চভিলাষ পূর্ন হবে না?
হামান তাকে অভয় দিয়ে বলল- হবে বন্ধু হবে, কিন্তু তুমি যত সহজ ভাবছো , কাজটা তত সহজ নয়। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে তোমাকে।
মানুষ যত বেশি পায়, ততই তার আশাও বেড়ে যায়। আশা মায়াবিনী। আশা ছলনাময়ী। আশার কোন শেষ নেই। সামান্য কৃষকের ছেলে আজ এক বিশাল সা¤্রাজ্যের দন্ডমুন্ডের কর্তা। আজ সে নিজেকে খোদা বলে দাবী করতেও কুন্ঠিত হচ্ছে না। লজ্জাবোধ করছে না।
তারপর হামানের কথা শুনে বলল- কি উপায়ে আমার আশা পূর্ণ হবে?
হামান বলল- সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দাও। তাহলে অশিক্ষিত জাতি ভাল-মন্দ বুঝতে পারবে না। অতি সহজেই তোমাকে খোদা বলে মেনে নিবে।
হামানের কথা মতে, দেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হল। ফেরাউনের এ ঘোষনার পর বনী ইসরাইলরা মহবিপদে পড়ে গেলো। তবুও তারা গোপনে লেখা-পড়া ও ধর্মালোচনা চালিয়ে যেতে লাগল। এভাবে চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলো। পূর্বের শিক্ষিত যারা ছিল তারা অনেকই মারা গেলো এবং যারা বেচে রইল তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হল।
সুতরাং জ্ঞানের , ন্যায়- অন্যায় এর কথা এবং ধর্মের কথা নিয়ে আলোচনা করার মত সাহস আর কারোই নেই।
হামান ফেরাউনের নিকট উপস্থিত হয়ে বলল-” জাঁহাপনা ! বহু দিন আগে যখন আপনি নিজেকে প্রভ‚ বলে দাবী করতে চেয়েছিলেন তখন আপনাকে আমি অনুকূল পরিবেশ হওয়া পযর্ন্ত অপেক্ষা করতে বলেছিলাম।
এখন সে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আপনার প্রভুত্ব দাবীর উপযুক্ত সময় এখন” এখন আর কেউ আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারবে না। কারণ ভালো-মন্দ বোঝার শক্তি আজ আর কারোরই নেই।
ফেরাউনের খোদায়ী দাবীর বিপক্ষে কথা বলতেন হযরত মূছা (আঃ) এবং হযরত আছিয়া (রাঃ) । তাই ফেরাউন হযরত আছিয়া (রাঃ) কে দীর্ঘদিন কারাবন্দী করে রেখে অবশেষে তাঁকে হত্যা করা হয়।
হযরত মূছা (আঃ) কে হত্যা করার জন্য তাঁর পিছু নিয়ে নীল নদের দিকে ছুটে যায়। তারপর ফেরাউন নীলনদে ডুবে মারা যায়। ফেরাউন মারা যাওয়ার সময় বলেছিল, ”আমি বিশ্বাস করিলাম বনী ইসরাইল যাহাতে বিশ্বাস করে। নিশ্চয় তিনি ব্যতিত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসর্পণকারীদের অর্ন্তভুক্ত।”
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের দোয়া কবুল করেনি। তাকে নীলনদে নিমজ্জীত করলেন ।
সম্মানিত দ্বীনি ভাই-বোন সময় থাকতে পাপ কাজ ছেড়ে দেই। আখিরাতের প্রতি ঝুঁকে পড়ি।
ধন্যবাদ