Hazrat Aysha (R:)

উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ)

 

অঢেল অন্তরঙ্গ উপাদান-উপকরণে ইসলামের ইতিহাসকে যিনি সমৃদ্ধ করেছেন , তাঁর প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির দীপ্তিতে ইসলামের অনুশাসনমালা প্রদীপ্ত, যাঁর ব্যক্তিতের ঐশ্বর্য ইসলামে নারীর অবস্থানকে সুনিশ্চিত করেছেন তিনিই হলেন মু’মিনগনের জননী, উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) তাঁর আসল নাম হল আয়েশা। ’সিদ্দিকা’ তাঁর একটি সম্মানিত উপাধি।

 

ইতিহাস বিখ্যাত এক সত্য উপলাদ্বকারী, সিদ্দিকের কন্যা। হযরত আবু বকর (রাঃ) এর দুহিতা। জন-আরোপিত ভিত্তিহীন অপবাদের অপনোদনে ঐশী বানী অবর্তীন হওয়ার কারনে স্বয়ং রসুল (সঃ) তাঁকে ’সিদ্দিকা ’ পদবীতে ভূষিত করেন এবং আদরার্থে তিনি তাঁকে ’হুমায়রা’ নামেও সম্বোধন করতেন। ’হুমায়রা’ শব্দের অর্থ ব্যঞ্জনা-’লালাভ গৌরবর্না। উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর গাত্রবর্ণের  রক্তিম উজ্জ্বলতাই এ প্রেমময় সম্বোধনের কারন। ইতিহাস বলে, প্রিয়তমের প্রেমসিক্ত এ সম্ভাষনে উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর চেহারা রক্তিমাভ হয়ে উঠত নারী সুলভ লজ্জায়। আর ’নবী পত্নীগন মু’মিনগনের মা’- আল্লাহর এ ঘোষনার পর স্বভিকভাবেই তিনি মুসলিম বিশ্বের মু’মিনগনের জননী, উম্মুল মু’মিনীন’।

 

উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর আরো একটি উপনাম রয়েছে-’উম্মে আবদুল্লাহ’। নিঃসন্তান হযরত আয়েশা (রাঃ) একবার কথা প্রসঙ্গে প্রিয় স্বামীকে বলেন ,অন্যান পত্নীকে লোকে তাদের নিজ নিজ সন্তানের মা বলে ডাকে। আমার তো কোন সন্তান নেই। লোকে আমাকে কার মা বলে ডাকবে?  রসুল (সঃ) বলেন , কেন, তুমি তোমার সহোদরা আসমার পুত্র আবদুল্লাহর নামানুসারে সম্বোধিতা হবে। মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল থেকে জানা যায়, ঐদিন থেকে সবাই তাঁকে উম্মে আব্দুল্লাহ নামে ডাকতে লাগলেন।

 

উম্মুল মু’মিনীন’ খেতাবটি আল্লাহর তরফ থেকে আসে তাঁকে উপলক্ষ করেই। পর্দার বিধান তখনো নাযিল হয়নি। একদিন নবী-দম্পতি আলাপচারিতায় মগ্ন। হঠাৎ এসে গেলেন আরব-বেদুইন-দাহিয়ায়ে কলবী। তখনো শালীনতা ও শিষ্টাচার বিষয়ে অনেকেই অজ্ঞ অমার্জিত। রসুল (সঃ) এর মর্যাদা সম্বন্ধে সমক্য ওয়াকিবহাল নয়। কালবী এর নিরক্ষর ভাষায় বেরিয়ে এলো  রসুল (সঃ) এর উদ্দেশ্যে -হে আল্লাহর রসুল (সঃ) আপনার মৃত্যুর পর হুমায়রা বিধবা হবেন। তাঁর যে বৈধব্য যন্ত্রণা আমি তা সহ্য করতে পারব না। আমি তখন তাঁকে বিয়ে করব। অসভ্য  বেদুইন তখনো জানে না কার সামনে তিনি কথা বলছেন। রসুল (রঃ) একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ; কিন্তু তখনই ধ্বনিত হল আসমানি স্বর;  নবী পত্নীগন মু’মিনদের জননী, আর তোমাদের উচিত নয় আল্লাহর রসুল (সঃ) এর মনে কষ্ট দেয়া,  আর তোমাদের পক্ষে উচিত নয় তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পত্নীগনকে বিবাহ করা।(আহযাব-৫৩)

 

সেদিন থেকে হযরত উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) সহ  মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর সমস্ত  পত্নীগন চিরদিনের জন্য উম্মুল-মু’মিনীন নামে পরিগনিতা হন। পিতা চিরপরিচিত হযরত আবু বকর (রাঃ) । আবু বকর বংশগত নাম পরিচয়। আসল নাম আব্দুল্লাহ । ’‍সিদ্দিক’ এবং ’আতিকুল্লাহ ‘ তাঁর উপাধি।  রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মিরাজ কাহিনীর সত্যতা সম্বন্ধে তাঁর কন্ঠেই বেজে উঠে অসংশয়িত প্রত্যয়ী সুর। “ হে আল্লাহর রসুল (সঃ) আপনি সত্য বলেছেন। আর হর্ষে উৎফুল্ল নবী (সঃ) তাঁকে  ‘সিদ্দিক’ নামে ভূষিত করেন। আর ইনলামের আদি পূর্বে তিনি যখন তাঁর জীবন ও ধন-সম্পদ উৎসর্গ করেছেন, তখন তাঁর বিশ্বাম-দৃঢ় অত্যুজ্জ্বল চেহারা  দেখে  আল্লাহর রসুল (সঃ) একদিন তাঁর অনুগামীদের বলেন ‘ইনি আতিকুল্লাহ ।’ অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত। সেদিন থেকে তাঁর ঐ মর্যাদা-ব্যঞ্জক ‘ আতিকুল্লাহ’ উপাধি। এমনই এক স্বনামধন্যের দুহিতা উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ)

 

উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায় না। তবে গবেষকগন লক্ষ করেছেন , হিজরতের তিন বছর আগে তাঁর বিবাহ হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর। তাঁর প্রথম পতিগৃহে যাত্রা প্রথম হিজরির শাওয়াল মাসে, তখন তাঁর বয়স নয় বছর। আর তাঁর বৈধব্যের কাল একাদশ ‍হিজরির রবিউল আউয়াল। এসব থেকে হিসাব উঠে আসে তাঁর জন্মবর্ষ ৬১৪ খ্রিঃ (জুলাই)।

 

মক্কার অভিজাত বিধি অনুযায়ী শিশু আয়েশার দুধমাতা ছিলেন হযরত ওয়ায়েল (রাঃ) ।  তাই তিনি ওয়ায়েল (রাঃ) এর পরিবারকে সারা জীবন সসম্মানে স্মরণ করেছেন।

 

জগৎ পরিবারের তীরে শিশুরা খেলা করে- এ তো কবির কবিতায় চয়ন নয়, বাস্তব সত্য। বয়সোচিত খেলাধুলার প্রতি শিশু আয়েশারও  ঝোঁক ছিল খুব। বিশেষত, তাঁর প্রিয় খেলা ছিল পুতুল খেলা, আর দোলনায় দোল খাওয়া। বালিকা হযরত আয়েশা (রাঃ) বিয়ের পরও পুতুল ‍ নিয়ে খেলেছেন।  স্বামীকে দেখে লুকিয়েও ফেলেছেন পুতুল। অথচ প্রবীন স্বামী এ প্রবনতাকে অবদমিত না করে উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর খেলার সাথীদের ডেকে এনে খেলতে বলেছেন। তাঁর পুতুল খেলার মধ্যেও ফুটে উঠেছিল তীক্ষ্ণ মেধার মুকুল। একটি ঘোড়া । পাখা আছে তার। আল্লাহর নবী (সঃ) তাঁর বালিকা বধূকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি?

’একটা ঘোড়া’

’ঘোড়ার তো পাখা নেই’

’কেন, হযরত সোলাইমান (আঃ) এর ঘোড়াগুলোর তো পাখা ছিল।’ বয়স্ক বন্ধু কেমন জব্দ! অকাট্য উত্তর। তাঁর প্রফুল্ল বদনে বয়ে যায় হালকা খুশির ঢেউ।

 

 দৌড় প্রতিযোগিতাও ছিল তাঁর ‍প্রিয় খেলা। আর তিনিই হতেন জয়ী।  পরবর্তীকালে জীবনের দূরপাল্লার দৌড়ে তিনি কতখানি এগিয়ে ছিলেন , ইতিহাস তার সাক্ষী। হযরত আসমা (রাঃ) সাক্ষ্য দেন ‍শিশু বয়সের খেলায়।

দোলনায় দুলতে দুলতে শিশু আয়েশা (রাঃ) আবৃত্তি করতেন আল-কোরআনের পবিত্র আয়াত। কিংবা কবি নবীদের কবিতা। আর সেসব কন্ঠস্থ হতো তাঁর পিতা বা আত্নীয়ের কাছ থেকে শুনে শুনে।   তাঁর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা প্রমানিত হয়েছে অমূল্য হাদিস বর্ণনায়। আর সে শক্তির পূর্বাভাস দেখা গেছে শৈশবেই। এমনকি , যুদ্ধযুদ্ধ খেলাও খেলেছেন তিনি, যা মেয়েদের খেলার বিষয় নয়, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি যে হবেন উটযুদ্ধের নায়িকা। তাই বাল্যকালে খেলাচ্ছলে তিনি যুদ্ধ করেছেন এক বালুকা স্তূপের দখল ‍নিতে। অতএব অনেকগুলো গুনের কুসুমকলি ফুটে উঠেছে বাল্যজীবনে;সাথীদের প্রতি সহানুভূতি ,সম্প্রীতি, মেধা, ইসলামী সংস্কৃতি এবং নেতৃত্ব দানের কুশলতা। পরিবার-প্রতিবেশ প্রচুর সম্ভারে সমৃদ্ধ করে তাঁকে তুলে দেয়া সমকালের হাতে। তিনিও তাঁকে নিয়ন্ত্রনে এনে চিরায়ত কালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেছেন।

 

উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদা (রাঃ) অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, পত্নী বিয়েগ-বিধুর রাসুল (সঃ) কে পুনরায় তাগাদা দেন হযরত খাওলা (রাঃ) আর সে প্রসঙ্গে তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদা (রাঃ) এবং উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নাম উল্লেখ করেন। আর আল্লাহর  অশেষ ইচ্ছায় দুইটি ক্ষেত্রেই তিনি কামীয়াবী প্রাপ্ত হন। হযরত খাওলা (রাঃ) এর প্রস্তাব শুনে হযরতা আবু বকর (রাঃ) অনেক খুশি হন।  তাঁর কন্যা নবী- পত্নী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে, এটা বড় সৌভাগ্য এবং আনন্দের বিষয়। অবশেষে ৬২০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে শুভ বিবাহ কার্য সুসসম্পন্ন হয়। মোহরানা  ধার্য হয় ৫০০ দিরহাম। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) এর বয়স তখন মাত্র  ছয় বছর। সেদিনও তিনি তাঁর বান্ধবীদের সাথে খেলায় মত্ত ছিলেন। তাঁকে ডেকে এনে বধুর সাজে সাজানো হয়। বিবাহ কি , তখনো তিনি জানতেন না। পরে বলেছেন, বিয়ের পর মা যখন আমাকে বাইরে যেতে মানা করলেন, আর বুঝিয়ে দিলেন বিয়ের ব্যাপার, তখন বুঝতে পারলাম যে, আমি বিবাহিতা।

 

সেদিন বিয়ের মজলিশে  দাঁড়িয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) যে আবেগস্পর্শী ভাষায় যে বক্তব্য  রাখেন, ইতিহাস তাকে হারিয়ে যেতে দেয়নি।  

 

” উপস্থিত মহোদয়গণ ! আপনারা সকলেই অবগত আছেন, রাসুল (সঃ) আমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার পয়গম্বর। মূর্খতার গভীর অন্ধকার থেকে  মুক্ত করে  তিনি আমাদের নিয়ে এসেছেন সত্যের আলোয়। তিনি আমাদেরে প্রকৃত বন্ধু, অতল গহবর জাহান্নামের দুয়ার থেকে ফিলিয়ে তিনি  আমাদের চিরমুক্তির পথের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।  এ আলোকে চির-অনির্বার রাখার জন্য , আমাদের এ অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে চিরদিন বজায় রাখার জন্য আমি অনেকদিন থেকে একটি উপায় খুঁজে আসছিলাম। মহান আল্লাহ তায়াল একটি উপায় বের করে দিলেন। তাই আজ আমার শিশু কন্যাটিকে আপনাদের খিদমতে উপস্থিত করেছি। এ কচিকাঁচা অবোধ মেয়েদের উপলক্ষ করে সমাজে আমরা কত যে অসংখ্য কুসংস্কার ও কু-প্রথার প্রচলন করেছি , কত যে , অমানবিক ও পৈশাচিক রীতিনীতি গড়ে তুলেছি , তার শেষ নেই। আমরা অকারনে নিরপরাধ অবোধ শিশু কন্যাকে মাটিতে পুঁতে ফেলি,পশুর মত নিতান্ত নির্দয়ভাবে হাত-পা বেঁধে দেব-দেবির পায়ে বলি দিয়ে থাকি, যাদের প্রাণে না মেরে বাঁচিয়ে রাখি তাদের প্রতিও পাশবিক অত্যাচার করে জীবন-মৃত করে রাখি। বন্ধুর কন্যা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কবিশিষ্ট না হলেও , তাকে বিবাহ করা আমরা গর্হিত ও ‍নিষিদ্ধ কাজ বলে গণ্য করি। এরূপ আরও অনেক কু-প্রথা  আমাদের সমাজে প্রচলিত । আজ আপনারা যদি আমার এ শিশু কন্যা আয়েশাকে রাসুল (সঃ)   এর হাতে তুলে দেন, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ বিবাহকে আদর্শ করে আরবভূমি হতে এসব কুসংস্কার ও কু-প্রথাকে চিরতরে উৎখাত করে দিতে পারবেন। এতে রাসুল (সঃ)   এর সাথে আমাদের বন্ধুত্বও চিরতরে প্রতিষ্ঠিত হবে। আর আমার বুদ্ধিদীপ্তা কন্যা রাসুল (সঃ) এর সাথে থেকে তাঁর পবিত্র আর্দশ ও বানীসমূহ সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞানলাভ করে তা জগতে প্রচার করতে সক্ষম হবে।”

 

অবশেষে বলা যায় যে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) যেমন জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ছিলেন, তেমনি স্বামীকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। তাঁহার স্মরণশাক্তিও ছিল প্রখর। তিনি নারী সমাজের একজন অসাধারন আদর্শ।

মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁহাকে পরকালীন জীবনে পূর্ণ মর্যাদা দান করুন। আমিন।

 

ভুল-ত্রুটি সংশোধনযোগ্য

ধন্যবাদ।

 

 

 

 


0 Comments

আমার ব্লগ তালিকা