হযরত আবু বকর (রাঃ) এর পরলোক গমন

হযরত রাসূলে কারীম (সঃ) এর ইন্তেকালে মুসলমানদের মধ্যে যে শোকের তুফান নেমে এসেছিল এবং বহু দুর্বল ঈমানদার মুসলমানদের  ব্যাপক ভাবে ধর্ম ত্যাগ, ধর্মদ্রোহিতা, যাকাতের  বিরোধিতা ও মিথ্যা নবুয়ত দাবি প্রভৃতি নানারূপ অরাজকতা  এবং বিশৃংখলা দেখা দিয়েছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) খেলাফতের  আসনে আসীন হয়ে  স্বীয় প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও অসাধারন  যোগ্যতার বলে এসব দুর্যোগের  মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  দেশে অচিরেই পূর্ণ শান্তি ও শৃংখলা দেখা দিয়েছিল।

 ইসলামের সকল বিপদ বিদূরীত হয়ে দিন দিন তার বিজয় পতাকা উড্ডীন হচ্ছিল। কেবল দেশের অভ্যন্তরেই নহে  বহির্দেশেও ইসলামের প্রসার ও রাজ্য বিস্তার শুরু হয়েছিল আর এইসব সাধিত হয়েছিল খুবই দ্রুত।

কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কুদরতের মহিমা  বুঝা বড় দায়। যে অন্যান সাধারন শক্তি, ব্যক্তিত্ব ও অতুলনীয়  প্রতিভার ফলে এসব ঘটেছিল সেই অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার ধারক হযরত আবু বকর (রাঃ) কেও মহান আল্লাহ তায়ালা বেশি দিন জীবিত  রাখা পছন্দ করলেন না। আল্লাহর ইচ্ছে হল শীঘ্রই তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ) কে রাসুলুল্লাহ  (সঃ) এর ন্যায়  নিজের কাছে তুলে নিলেন।  ত্রয়োদশ  হিজরী সনের মজাদিউস সানী মাসে খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) হঠাৎ কাঠন জ্বরাক্রান্ত হয়ে পরলেন।  জ্বরের সাথে সাথে আনুষঙ্গিক অসুস্থতার লক্ষণসমূহও পুরোপুরিভাবে  দেখা ‍দিল । অসুস্থতার প্রকোপ ক্রমেই বৃদ্ধি  পেতে লাগল। এভাবে প্রায় পনের দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো কিন্তু অসুস্থতার বেগ  না কমে বরং ক্রমেই  বেড়ে চলল। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন যে তাঁর অন্তিম  মুহূর্তের আর বেশি  বাকি নেই , ঘনিয়ে আসছে, ইহা বুঝতে পেরে  তিনি সেই অসুস্থ অবস্থায়াই ভালভাবে গোসল করলেন।  ইহার ফলে তাঁর রোগ আরো বৃদ্ধি পেলো।

এ সময়টি মুসলমানদের জন্য খুবই সঙ্কটময় সময় ছিল, কেননা মুসলমানদের দ’টি প্রবল শত্রু ইরানী ও রোমানদের  বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঘোরতর যুদ্ধ চলছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির কথা সম্যকরূপে অনুধাব করে মনে মনে চিন্তা করলেন  তাঁর জীবদ্দশাই যদি  এখন সর্বসম্মতিক্রমে একজন খলিফা নির্বাচন করা যায় তাহলে  তাঁর অবর্তমানে  এ ব্যাপার নিয়ে আর কোনরূপ দুর্যোগ দেখা দিবার আশঙ্কা থাকবে না।

পূর্ব থেকেই তিনি হযরত ওমার (রাঃ) এর প্রতি সুধারনা পোষণ করতেন। তাঁর এ ধারনা ছিল যে , তাঁর লোকান্তরে হযরত ওমার (রাঃ) খলিফা পদে বহাল থাকলেই মুসলমানদের কল্যান হবেই।

অতএব, তিনি প্রধান প্রধান সাহাবীগণকে ডেকে হযরত ওমার ফারুক (রাঃ) কে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করা সম্পর্কে তাদের মতামত  জানতে চাইলেন। সমবেত সাহাবীমন্ডলীর সকলেই হযরত  আবু বকর (রাঃ) এর মত সমর্থন করে হযরত ওমার ফারুক (রাঃ) কে খলিফা নিবাচন করতে মত প্রদান করলেন।

অবশ্য দু’একজন লোক সামান্য একটু আপত্তি করে বললেন যে, তাঁর গুন ও যোগ্যতা সম্পর্কে কারো কিছু বলার নেই, কিন্তু তিনি বড় বেশী কড়া মেজাজের । তাদের কথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন, দেখুন , হযরত ওমার ফারুক (রাঃ)  যে রকম পাষাণের কঠিন, ঠিক সেরূপ আবার মাটির মতই নরম। আপনারা শুধু তাঁর বাইরের রূপটাই দেখেছেন, কিন্তু তাঁর অভ্যন্তরটা শুধু আমি  সর্বাপেক্ষা বেশী জ্ঞাত।  আমি একটু বেশী পরিমানে কোমল হৃদয় ছিলাম। তাই তিনি কঠিন রূপটাই বেশী প্রকাশ করেছেন। আমার বর্তমানে তাঁর প্রয়োজনও ‍ ছিল। কিন্তু আমি যখন থাকব না, খেলাফতের দায়িত্ব তাঁর নিজের মাথায় অর্পিত হবে, তখন কর্তব্য  স্থলে তাকে পাষাণতুল্য কঠিন আবার প্রয়োজনে  কুসুম অপেক্ষাও কোমল দেখতে পাবেন।

হযরত  আবু বকর (রাঃ) এর কথা শুনে সকলেই বিশেষভাবে আশ্বস্ত হলেন। তখন হযরত ওমার ফারুক (রাঃ) এর খলিফা নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে আর কারো কোনরূপ আপত্তি থাকল না। সকলেই তাঁর প্রতি সমর্থন দিলেন। অতঃপর হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ)  কে লক্ষ্য করে বললেন, কগজ-কলম নিয়ে আস। উহা আনা হলে খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ) কর্তৃক হযরত ওমার ফারুক (রাঃ) এর খেলাফত সম্বন্ধে একখানা অছিয়ত নামা লিখে দিলেন। খেলাফত  সম্বন্ধে এরূপ অছিয়ত নামা প্রস্তুত করা ইসলামের ইতিহাসে ইহাই সর্বপ্রথম।

হযরত আবু বকর (রাঃ)  নিজেই অছিয়তনামার বিষয়বস্তু পাঠ করে সকলকে শুনালেন।  সকলেই হযরত ওমার ফারুক (রাঃ)  কে পরবর্তী খলিফা  হিসাবে স্বীকার করে নিলেন।

অতঃপর উক্ত অছিয়তনামা হযরত রাসুলে কারীম (সঃ) এর নামের সীলমহর অঙ্কিত করে দেয়া হল। এর পরে হযরত আবু বকর (রাঃ)  অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেন। তাঁর আর মসজিদে ‍গিয়ে সালাত আদায় করার শক্তি রইল না । তখন তিনি ইমামতির  ভার হযরত ওমার ফারুক (রাঃ)  এর উপর অর্পণ করলেন।

হযরত আবু বকর (রাঃ)  এর অবস্থা গুরুতর দেখে সাহাবাদের  মধ্যে  কেউ কেউ বললেন একজন উপযুক্ত চিকিৎসক ডেকে এনে ভালভাবে চিকিৎসা করালে ভাল হত।

তাদের এ কথার জবাবে হযরত আবু বকর (রাঃ)  বললেন , হ্যাঁ , আপনারা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু যে  চিকিৎসক আমার চিকিৎসা করবেন তিনি তো  পূর্বেই আমাকে দেখেছেন এবং যা বলার বলে দিয়েছেন। হযরত আবু বকর (রাঃ)  এর কথার তাৎপর্য অনেকেই বুঝতে পারলেন না যে কখন কোন চিকিৎসক আগমন করেছিল এবং সে কি বলে গিয়েছে। অতএব, তারা হযরত আবু বকর (রাঃ)  কে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা আপনার কথা বুঝতে পারলাম না ।  তখন হযরত আবু বকর (রাঃ)  বললেন আমি যা বলেছি ঠিকই বলেছি। কোন চিকিৎসক ডেকে লাভ নেই।  সবার বড় চিকিৎসক যিনি তাঁর কথা আমি ভালরূপেই বুঝতে পেরেছি।

হযরত আবু বকর (রাঃ)  এর কথা শুনে সকলেই এবার উহার মর্ম বুঝতে পারলেন। তারা আর কেউ কিছু বলল না । তাদের অনেকেরই অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো। এরপর তিনি বাকি দিন কয়টি মসজিদে নব্বীর নিকটে যে স্থানটিতে হযরত রাসূলে কারীম (সঃ) এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল , সে স্থানেই অতিবাহিত করলেন। একদা তিনি হযরত ওমার ফারুক (রাঃ) কে ‍নিজের কাছে ডেকে কতকগুলো প্রয়োজনীয় বিষয়ে উপদেশ দান করলেন। অতঃপর তার নিজের পারিবারিক কতকগুলো বিষয় সম্বন্ধেও  হযরত ওমার ফারুক (রাঃ) কে অছিয়ত করলেন।

তিনি হযরত ওমার ফারুক (রাঃ) বললেন “ আমার অমুক জমি খন্ড যার উৎপন্ন শস্য আমি আমার খেলাফতের অজিফা ( ভাতা) স্বরূপ গ্রহন করতাম উহা বিক্রয় করে বিক্রয় লব্ধ অর্থ বায়তুল মালের তহবিলে জমা দিয়ে দিবেন। আর আমার পরিধানে  এখন যে কাপড় রয়েছে ইহা ধৌত করে উহার সাথে আরো দু’খানা কাপড় মিলিয়ে তা দ্বারা আমার কাফনের কাপড় সমাধা করবেন।”

কন্যা আয়েশা নিকটেই  উপস্থিত ছিলেন ।  তিনি অত্যন্ত ব্যথিত স্বরে বললেন, আব্বাজান! পুরাতন কাপড়ের দ্বারা কাফনের কাজ সারা হবে কেন? হযরত আবু বকর (রাঃ)   বললেন , মা , মৃত ব্যক্তির জন্য পুরাতন ছেঁড়া কাটা কাপড়ই তো যথেষ্ট । কাপড় শুধু পাক্ পবিত্র হলেই চলবে। অতঃপর কন্যাকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন মা আমার নিকট যা কিছু অতিরিক্ত থাকে তা ওমরের নিকট পাঠিয়ে দাও , সে উহা বাইতুল মালে জমা দিয়ে দিবে।

পিতার নির্দেশ মোতাবেক মা আয়েশা (রাঃ) এর বাহু অনুসন্ধান করে দেখলেন, হযরত আবু বকর (রাঃ) এর ব্যক্তিগত কোন জিনিষই পাওয়া গেলো না । শুধু একজন বাদী ও একটি উট ব্যতীত।  মৃত্যুকালে হযরত আবু বকর (রাঃ)   যিনি সমগ্র মুসলিম সম্রাজ্যের একচ্ছত্র খলিফা তাঁর ব্যক্তিগত  সম্পদ বলতে শুধু তখন  তাঁর নিকট ইহাই ছিল। ত্যাগের পরকাষ্ঠার নিদর্শন ইহা ব্যতীত আর কি হতে পারে । হযরত আয়েশা (রাঃ) বাদীকে আযাদ করে দিলেন। উটটি বাইতুল মালে জমা দিয়ে দিলেন। মা আয়েশা (রাঃ)  এভাবে পিতার ‍নির্দেশ পালন করে স্বস্তির ‍ নিঃশ্বাস  ফেললেন  এবং পিতার ‍নিকট তা জানালেন।

হযরত আবু বকর (রাঃ)  অত্যন্ত খুশি হলেন। অতঃপর হযরত আবু বকর (রাঃ) অতি কষ্টে দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করে নিলেন এবং মহান  আল্লাহ তায়ালার ‍নিকট প্রার্থনা করলেন। হে আল্লাহ আমি যে মুসলমানের সর্ব প্রকার কল্যান ও মঙ্গলের জন্য একজন যথোপযুক্ত খলিফা মনোনয়ন করতে  পেরেছি, এজন্য আমি আপনার পবিত্র দরবারে সহস্র শোকরিয় জানাচ্ছি। মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ ও কলহ-কোন্দল সৃষ্টি না হতে পারে তজ্জন্যই আমি এরূপ ব্যবস্থা গ্রহন করা অত্যন্ত প্রয়োজন বোধ করছি। হে ভিতর-বাহির ও প্রকাশ্য-গুপ্ত দর্শক আল্লাহ আপনি আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বিষয় সবই অবগত আছেন। যদি কোন কাজে আমি ভুল করে থাকি তবি আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন আর কর্ম সঠিক হয় তবে তা আপনি  কবুল করে নিবেন।

হে আল্লাহ আমার ওমার ফারুক (রাঃ)  কে খলিফ মনোনয়নের ব্যাপারে অনেক যুক্তি  ও সুদূর প্রসারী কারনসমূহ রয়েছে।  আপনি তা সকলই জানেন। চরিত্রে ও বীরত্বে আমি হযরত ওমার (রাঃ) কে শ্রেষ্ঠ মনে করছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস , সত্যের জন্য কঠোর সংগ্রামে হযরত ওমার (রাঃ এর মত কঠোর ও দৃঢ়মনা  ব্যক্তি দ্বিতীয় আর কেউ নেই।

হে আল্লাহ আমি ইসলাম গ্রহন করার পর  থেকে আপনার ও আপনার রাসূল (সঃ) এর পথে চলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, তাতে  আমি কতটুকু সফল হয়েছি তা সর্বাপেক্ষা আপনিই ভাল জানেন।

হে আল্লাহ ! আমার প্রার্থনা  আমার পর যে মুসলমানের কাফেলা থাকবে তাদেরকে আপনি সৎ ও সুস্থ রাখুন ও তাদেরকে সরল পথে পরিচালিথ করুন।

 

হযরত আবু বকর (রাঃ)   তাঁর বিদায় অত্যাসন্নর  এ কথা  নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তিনি সকল কর্তব্যসমূহ সঠিকভাবে সম্পন্ন করলেন। যা কিছু করবার তা সবই করলেন। পরিবার-পরিজন, মুসলিম জনসাধারন, সাহাবীবৃন্দ ও বন্ধবান্ধবগণ ভাবী খলিফা হযরত ওমার ফারুক (রাঃ)  কে প্রয়োজনীয় নসীয়ত-অছিয়ত প্রদান করলেন। তাছাড়া তাঁর চোখর পত্তলি  হৃদয়ের নিধি স্নেহের কন্যা হযরত আয়েশা ‍ সিদ্দীকা (রাঃ)  কে বহু উপদেশ প্রদান করলেন। অবশেষে তাঁর জীবনের শেষ দিনটি সমাগত হল। সে দিনটি ছিল জমাদিউস সানীর বাইশে সোমবার। ঐ দিন রাত্রে মুসলিম জাহানের  প্রথম খলিফা হযরত রাসূলে কারীম (সঃ) এর সর্বাধিক প্রিয় ও অন্তরঙ্গ বন্ধু হযরত আবু বকর (রাঃ)   পার্থিব জগতের মায়া কাটিয়ে প্রিয় আল্লাহর  সান্নিধ্যে চলে গেলেন ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন) । শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি বার বার  এ কথাটি বলতে ছিলেন-ওহে দয়াময় আল্লাহ  আমি তোমার বিশ্বাসী এক মুসলমান ,তুমি আমাকে পুরাপুরি মুসলমান অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দাও।

 

যে রাত্রে তাঁর মৃত্যু  ঘটে সেই রাত্রেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর কাফনে তিন খন্ড কাপড় ব্যবহার করা হল এবং তাঁর নিজের অসিয়ত পুরোপুরিভাবে পালন করা হল। অর্থাৎ কাফনে কোন নতুন কাপড় ব্যবহার না করে তিনখানা পুরাতন কাপড় দ্বারা প্রস্তুত করা হয়েছিল। হযরত রাসেূলে কারীম (সঃ) জীবদ্দশায়ই তাঁর প্রধান বন্ধুর  জন্য চিরশয্যার স্থান ‍নির্দিষ্ট করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই নির্দেশ অনুসারেই তাঁর পবিত্র রওজার পাশে তাঁর কাঁধ বরাবর মস্তক স্থাপন করে হযরত আবু বকর (রাঃ)  কে সমাহিত করা হয়।

 

 

 

 

 

 

 

 


0 Comments

আমার ব্লগ তালিকা